• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

কানাডায় প্রথম বরফ দেখার দিনটা 


লুৎফর রহমান রিটন
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৯, ২০২১, ০৯:১১ এএম
কানাডায় প্রথম বরফ দেখার দিনটা 

টোকিও থেকে নিউইয়র্ক হয়ে মন্ট্রিয়লের লাকোল বর্ডার দিয়ে নদী এবং শার্লিকে নিয়ে কানাডায় ঢুকেছিলাম আজ থেকে কুড়ি বছর আগে। দিনটা ছিলো ২৮ মার্চ। সাল ২০০২। নিউইয়র্ক থেকে আমাদের নিয়ে এসেছিলো গ্রেহাউন্ড নামের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোচ। সাইজে বাসটা বিশাল ছিলো। আর বাসের চালক ভদ্রমহিলাও ছিলেন দশাসই শারীরিক গড়নের। শক্তিশালী সেই ভদ্রমহিলা যাত্রীদের বিরাট বিরাট লাগেজগুলো দুই হাতে দুইটাকে তুলে চালান করছিলেন উঁচু বাসের নিচের কম্পার্টমেন্টে, কারো কোনো সহযোগিতা ছাড়াই। লাকোল বর্ডার ক্রস করার পর প্রাকৃতিক দৃশ্যপট বদলে গেলো মুহূর্তেই। চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠলো নতুন আরেকটা দেশের চিত্রকল্প। এই দেশটার রঙ ভিন্ন। গঠন ভিন্ন। শুধু গাছগুলোর চেহারায় অপরূপ সাদৃশ্য দুই দেশের। 
কানাডা বর্ডারে কাস্টমসের আনুষ্ঠানিকতা সেরে হাতে কিছুটা সময় পাওয়া গেলো। আমাদের লাগেজগুলো গ্রেহাউন্ডের পেটে ফের জমা রাখলেন ড্রাইভার।  

বিরাট বাসটা অটোয়ার দিকে ছুটছে। স্বচ্ছ কাঁচের জানালায় কানাডার দৃশ্য দেখতে দেখতে অটোয়া অভিমুখে যাচ্ছি। চকচকে ঝকঝকে রোদ চতুর্দিকে। কিছুদিন আগেও দেশটা বরফ আচ্ছ্বাদিত ছিলো। এখন বরফ গলছে। চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো বরফ। কোথাও কোথাও বরফের স্তরের নিচে উঁকি দিচ্ছে এককালের সবুজ বর্তমানের ফ্যাকাসে দুর্বাঘাসের ম্রিয়মান শবদেহ। 

ঘন্টাখানেক চলার পরেই হঠাৎ বিকট শব্দে ফেটে গেলো আমাদের বহনকারী গ্রেহাউন্ডের টায়ার। কোনো মতে রাস্তার পাশে একটা প্লাজার সামনে বাস থেকে নামিয়ে দেয়া হলো আমাদের। যাত্রীদের বলা হলো খানিকটা সময় লাগবে। প্লাজার কফিশপ এবং অন্যান্য দোকানে ঘুরে সময় কাটানোর পরামর্শও দেয়া হলো যাত্রীদের। একটা কফি শপের সামনের স্পেসে চারিদিকে গলমান বরফের আস্তরণের মধ্যিখানে বরফশুন্য একটা প্রায় গোলাকার ষড়ভূজ জায়গায় থাকা স্থায়ী পাথুরে বেঞ্চিতে বসে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো শার্লি। এই প্রথম সে বরফ দেখছে। তখনও মোবাইল ফোনে ক্যামেরা আসেনি। আমার সঙ্গে থাকা ক্যামেরায় উৎফুল্ল শার্লির একটা ছবি তুলে রাখলাম। (এই লেখার সঙ্গে সেই ছবিটাও যুক্ত করে দেবো)।  

সেই বিকেলে বরফ দর্শনে আমি এবং নদীও ছিলাম বিস্মিত। প্রগতি আর রাদুগার কল্যাণে রাশান শিশুসাহিত্যের বইগুলো পড়া ছিলো বলে শীতপ্রধান দেশ রাশিয়া কিংবা কানাডার শীত-ঠান্ডা আর বরফ বা স্নোপ্লাবিত মৌশুমের বিষয়ে কিছুটা পূর্ব ধারণা ছিলো। ফলে আমার বিস্ময়ের পরিমাণটা ছিলো কম। কিন্তু বছর ঘুরতেই বুঝে গেলাম কানাডার শীত কিংবা বরফ বিষয়ে আমার জ্ঞাণ আসলে শিশু পর্যায়ের। মাইনাস থার্টি-ফর্টির কাহিনীটা তো জানতামই না! এই দেশের শীত আর বরফের তুলনায় আমার জানা শীত আর বরফটা নিতান্তই 'শীতের ডিম' লেভেলের। সেই ডিম ফুটে বাচ্চা বেরুলে কী ভয়ংকর শীত আর বরফের থাবার নিচে পড়তে হয় সেটা জেনেছি এক বছর পর।        

২০০২ সালে এপ্রিলের ৩ তারিখ বিকেলে আমার ভাড়া নেয়া এপার্টমেন্টের চুক্তিপত্রে সাক্ষর ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন করতে অটোয়ার 'মিন্‌টো' MINTO নামের কোম্পানি অফিসে গিয়েছিলাম। চুক্তিপত্র এবং এপার্টমেন্টের চাবি হাতে ওখান থেকে বেরোতেই দেখি স্নো পড়ছে। ফুলের পাপড়ির মতো হালকা হালকা বরফের (কানাডায় যাকে ফ্লুরিস বলা হয়) ফুল ঝরে পড়ছে আকাশ থেকে। আকাশ থেকে ভাসতে ভাসতে আমার ওভারকোট আর ঝাঁকড়া চুলের ওপর এসে ল্যান্ড করছে কোনো কোনো বরফের ফুল। কানাডার বরফের সঙ্গে সেই আমার প্রথম মোলাকাত।(সেদিনের সেই স্মৃতিময় দৃশ্যটাও টোকিও থেকে কেনা আমার ছোট্ট ক্যামেরায় ধারণ করা ছিলো।) আনন্দে প্রায় নৃত্য করছিলাম আমি। আমার আনন্দ দেখে বয়স্ক এক ভদ্রমহিলা আমাকে বলেছিলেন--স্নো দেখিয়া তোমার ডান্সিং মুড দেখিয়া মনে হইতেছে কানাডায় নতুন আসিয়াছো?

আমি হ্যা সূচক জবাব দিলে সেই মহিলা ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন-- এক দুই বছর থাকো। কাঁদিবে। নিশ্চয়ই তুমি কাঁদিবে!...   

এরপর দিন গড়িয়েছে। কানাডার শীতের সঙ্গে আমার বোঝাপড়া হয়েছে ক্রমে ক্রমে। গাড়ি কেনার পর আমার জানা হয়েছে কানাডায় বছর বছর সামার আর উইন্টার সিজনে দুই রকমের টায়ার ব্যবহার করতে হয়। সামারের টায়ারে গাড়ি চালানো যাবে না উইন্টার সিজনে। এটা বাধ্যতামূলক। অন্টারিওতে আইন রয়েছে এই বিষয়ে। এটা মাস্ট। নইলে বরফপ্লাবিত রাস্তায় গাড়ির চাকা পিছলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে বিশাল দায় নিতে হয় গাড়ির মালিক এবং ড্রাইভারকে। টাকার অঙ্কের জরিমানা ছাড়াও ড্রাইভিং লাইসেন্স হুমকির মুখে পড়ে। লাইসেন্স বাতিলেরও বিধান আছে সেই আইনে। 

প্রতি বছর অক্টোবর নভেম্বরে গাড়িতে উইন্টার টায়ার লাগাই এবং এপ্রিল মে মাসে সেই চাকা খুলে সেখানে প্রতিস্থাপন করতে হয় সামার টায়ার। প্রতিবার খরচ ১০০ ডলার। অর্থাৎ কীনা বছরে আমার ২০০ ডলার খর্চা হয় এই টায়ারের ওঠানামা খাতে। 

কানাডায় বরফ কালে নানান প্রকারের স্নোর মোকাবেলা করতে হয়। 

স্নো স্টর্ম হলে মহা বিপদ। সারারাত সারাদিন ধরে বরফ পড়ে। শাদা বরফের বিপুল সমাগমে পুরো শহরটা শাদাকার্পেটের ঘোমটার ভেতরে যেনো বা আড়াল করে ফেলে নিজেকে। শহরটা ডুবে যায় বরফের তলায়। 

বাড়ি-বাড়ির ছাদ-গাড়ি-রাস্তা-পার্ক-মাঠ-নদী সবকিছু ডুবে যায় শ্বেতশুভ্র বরফের তলায়। রাস্তায় বরফের স্তর উঁচু হতে থাকে। সেই রাস্তায় গাড়ি চালালে নৌকার দুলুনি টের পাওয়া যায়। একবার তো আমার মনে হয়েছিলো--গাড়ি না, আমি চালাচ্ছি নৌকা। নৌকাটা দুলছে বরফের ঢেউয়ে।  

এই সময়টায় বর্ণিল কানাডা হয়ে ওঠে রঙহীন। যতোদূর চোখ যায় কেবল শাদা আর শাদা। বাড়ি শাদা গাড়ি শাদা ছাদ শাদা রাস্তা শাদা মাঠ শাদা গাছ শাদা নদী শাদা এক কথায়--দৃষ্টি সীমানায় যা কিছু সবই শাদা। এই সময়টায় কানাডায় বেড়ে যায় ডিপ্রেশনের রোগী। বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে মানুষ। আমাকেও একবার যেতে হয়েছিলো চিকিৎসকের কাছে কাউন্সেলিং-এর জন্যে।  চিকিৎসক আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেই বুঝে গিয়েছিলেন কেনো আমি ডিপ্রেসড্‌। আমার অতীত দিনের কাহিনি কিছুটা শুনেই বলেছিলেন তিনি--তুমি আসলে রঙের মানুষ। উজ্জ্বল বর্ণাঢ্য রঙ তোমার পছন্দ। কানাডায় এই সময়টায় শাদা ছাড়া আর কোনো রঙ থাকে না। এই সময়টায় আমাদিগকে সামাল দিতে হয় তোমার মতোন রঙিলা মানুষদের। এক্ষণে তোমার জন্যে আমার প্রেসক্রিপশন হইতেছে--ঘরের দেয়ালে সবুজ রঙের আধিক্য এমন কোনো পোস্টার ঝুলাইয়া দাও। ঘরের ভিতরে স্থাপন করো সবুজ পত্রপল্লবসমৃদ্ধ নকল বৃক্ষ। রিজনেবল মূল্যে সবুজ পাতাওয়ালা বৃক্ষ তুমি কিনিতে পাইবে ওয়ালমার্টে। আর হ্যাঁ, ঘরের ভিততে অন্তত একটি বিশেষ ল্যাম্প স্ট্যান্ড লাগিবে যেইখানে (নাম ভুলে গেছি) একটি বিশেষ ধরণের লাইট জ্বালাইয়া রাখিবে। এই লাইট হইতে বিচ্ছুরিত আলো ডিপ্রেশন হইতে তোমাকে রক্ষা করিবে। 

(চিকিৎসকের সবক'টা পরামর্শ আমি মেনেছিলাম। সত্যি সত্যি ডিপ্রেশনের মাত্রাটা হ্রাস পেয়েছিলো)।

একটা পর্যায়ে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্বে) শীতের মাত্রা হিমাঙ্কের নিচে মাইনাস ত্রিশ-চল্লিশে নেমে গেলে পত্রপল্লবহীন ন্যাড়া গাছগুলোর শাখা-প্রশাখায় অর্থাৎ ডালে ডালে জমে থাকা বরফগুলো ক্রিস্টালের মতো চকচকে হয়ে ওঠে। তবে সবচে ভয়ংকর হচ্ছে ফ্রিজিং রেইন। বৃষ্টির ফোঁটার মতো বরফ মাটিতে পড়েই শক্ত কাঁচের মতো হয়ে যায়। সমস্ত রাস্তা স্লিপারি বা পিচ্ছিল হয়ে ওঠে। এমন পিচ্ছিল যে কয়েক কদম হাঁটতে গেলেও পা পিছলে ধপ্পাস। এই সময়টায় আমি গাড়ি ড্রাইভ করা থেকে বিরত থাকি। কারণ পিচ্ছিল রাস্তায় পিছলে যায় গাড়ির চাকা। এমনকি উইন্টার টায়ারও। কোনো ড্রাইভারই নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না স্টিয়ারিং কিংবা ব্রেকে। স্টিয়ারিং সোজাসুজি ধরে রাখলেও গাড়ির চাকা স্লাইডিং-এর শিকার হয়। ব্রেক-এ পা ঠেসে দিলেও গাড়ি থামে না। লেন চেইঞ্জ করে চলে যায় পাশের লেনে। কিংবা না থেমে সামনে এগিয়ে গিয়ে হামলে পড়ে অন্য গাড়ির ওপর। ফ্রিজিং রেইন হলে হাইওয়ের রাস্তায়ও ঘটে অসংখ্য দুর্ঘটনা।

আমার গাড়িও একবার ওরকম স্লাইডিং পদ্ধতিতে আমার ধরে থাকা স্টিয়ারিং কিংবা ব্রেকে চেপে রাখা পায়ের নির্দেশনা অমান্য করে এগিয়ে যেতে যেতে  ঢুকে পড়েছিলো পাশের লেনে। বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা আরেকটা গাড়ির সঙ্গে আমার গাড়ির সংঘর্ষ ঘটেনি মাত্র এক ইঞ্চি ব্যবধানের কারণে। সে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা ছিলো। 

ফ্রিজিং রেইন হলে এখন আমি গাড়ি চালাই না। একেবারেই না।  

প্রচন্ড শীত আর বরফকালে পরিবর্তিত হয় মানুষের পোশাক। পরিবর্তিত হয় জুতো। এই সময়ে সাধারণ জুতোর জায়গায় পায়ে উঠে আসে উইন্টার বুট। ভারী জ্যাকেট-ইনার-প্যান্ট-গ্লোভস-কান ঢাকা মাংকি টুপি-বুট ইত্যাদি শীত পোশাকে সজ্জিত চলমান মানুষগুলোর একেকজনকে মনে হয় নভোচারী। নারী পুরুষের পরিচয় লোপাট হয়। এই সময়টায় চলমান মানুষগুলোর মধ্যে কে নারী আর কে পুরুষ সেটা বুঝতে স্বয়ং ঈশ্বরও মনে হয় বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়।  

কানাডার শীত আর বরফ নিয়ে বিস্তারিত বলতে গেলে লিখতে হবে সাত প্রস্থের রামায়ণ। 
আজ ক্ষ্যান্ত দিই। আরেকদিন না হয় লিখবো সেই উপাখ্যান। 

 

অটোয়া ১৮ ডিসেম্বর ২০২১

Link copied!